আউটসোর্সিং শব্দটা আজও বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে একটি রহস্য যেটার আড়ালে আছে কিছু ভদ্রবেশী ভার্চুয়াল ভিক্ষুক; যারা শুধুমাত্র ভিক্ষা করে এমনটা নয় বরং তারা আউটসোর্সিং উৎসাহী নবপ্রাণ তরুণদের ইচ্ছাশক্তি ও জীবন নষ্ট করে দেয় তাই তাদের ভার্চুয়াল ডাকাত বলাও ভুল নয়….আমাদের উচিত এইসব প্রতারকদের থেকে দূরে থাকা এবং অন্যদেরও সচেতন করা।
আউটসোর্সিং করে বেকারত্ব দূর করুন
“আউটসোর্সিং করে বেকারত্ব দূর করুন কিংবা মাসে হাজার হাজার টাকা ইন্টারনেট হতে ইনকাম করুন” এমন প্রলোভনী বিজ্ঞাপনে একটা সময় বাংলাদেশে কিছু কোর্স করানো কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছিলো (এখনো এমন বহু কোর্স ব্যবসায়ী ট্রেনিং সেন্টার খুজে পাবেন)। আবার ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার সময়ে অনলাইন কোর্স করানোর বিষয়টি যেন ডিজিটাল ডাকাতির রূপ নিয়েছে।
সবার আগে কমনসেন্স নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন “যারা প্রতিমাসে ইন্টারনেট হতে লক্ষ টাকা ইনকাম করার নিয়ম জানেন তারা কেন নিজেরা কোর্স বিক্রি করে হাজার টাকা ইনকাম করার জন্য পড়িমরি হয়ে যান?”
দেখুন নিজের শিক্ষা ব্যবহার করে সময়ের সাথে সংগত আউটসোর্সিং ট্রেনিং করানো কখনোই খারাপ কিছু নয় তবে আহামরি বিজ্ঞাপন যেমন ডাহা মিথ্যা কথা তেমনি কোর্স করানো বহু ট্রেনিং সেন্টার/ অনলাইন কোর্স আদতে ভড়ে ভাবানী। আবার বর্তমানে অনলাইন কোর্স করানোর নামে সিডি/ডিভিডি বিক্রি করা কিছু ফেরিওয়ালাও খুজে পাবেন, যারা ২৫ টাকার দামের সিডি কপি করে ২৫ হাজার টাকা কামিয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যান!
মুখোশ উন্মোচন:
আমরা অনেক সময় পোস্টার/লিফলেটে এমন সফল মানুষদের দেখি যারা নাকি তাদের কোর্স মাসে লক্ষ টাকা ইনকাম করছেন, আদতে তারা হয়তো ১০০ টাকার বিনিময়ে নয়তো রেপুটেশন ক্রিয়েট করতে বিজ্ঞাপনের মডেলিং করলেন মাত্র। আবার অনেক সময় নিজেকে প্রচার করতেও বহু ট্রেনি তাদের নিজেকে বিকিয়ে দেন (পোস্টারে নিজের ছবি দেখলে খুশী হওয়া পাবলিক বাংলাদেশে কম নয়)!
আসলে কোর্স করানোর নামে তারা আপনাকে বেসিক কিছু নলেজ দিবেন যেমন (১) ওয়েবসাইট কি (২) ডোমেইন কি (৩)হোস্টিং কি (৪) ডিএনএস সেটিংস (৫) ওয়েবসাইট তৈরী (৬) ওয়েব পেইজ ডিজাইন ইত্যাদি।
অবশ্যই উপরোক্ত বিষয়গুলি আপনার জন্য জানা আবশ্যক তবে আপনি চাইলেই এমন কমন বিষয়গুলি ইন্টারনেট হতে টিউটোরিয়াল পড়েই শিখতে এবং প্র্যাকটিস করতে পারবেন তাহলে টাকা খরচ করবেন কেন?!
মনে রাখুন “ফলের রস বানিয়ে খাওয়া আর রেডিমেড জুস খাওয়ার মাঝে আসল তফাতটাই হলো অলসতা” আর অলস মানুষ কখনোই ইন্টারনেটে আউটসোর্সিং করতে সফল হতে পারবেন না…ইটস ওভার গ্যারান্টেড!!!
ঠুকনো কোর্স ব্যাবসায়ী ট্রেনিং সেন্টারগুলা আপনাকে শুধুমাত্র বেসিক শিখিয়ে বলে দিবে “যাও এবার অনলাইনে ইনকাম করো” অথচ তারা আপনাকে ইনকামের পথ দেখিয়ে দিবে না কিংবা আপনি কাজ করে টাকা উপার্জন করা অবধি দায়িত্ব নিবেন না (যদিও শুরুতে তাদের মিষ্টি কথাতে নিশ্চিত আপনি তাদের প্রেমে পড়ে যাবেন… আহা এরোম ভালো মানুষ আর দুনিয়াতে হয় নাকি)!
আউটসোর্সিং করতে গুরু ধরা লাগে না
আউটসোর্সিং মানে “বাইরের সোর্স হতে ইনকাম” সেটা হতে পারে ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং কিংবা ব্লগিং- কনটেন্ট রাইটিং, ওয়েব ডেভলপিং-ওয়েব ডিজাইন,গ্রাফিক্স ডিজাইন,ক্রিপ্টো ট্রেডিং,সোস্যাল মার্কেটিং ইত্যাদি ইত্যাদি। সবচেয়ে মজার সত্যটা হলো এইসব কিছু আপনি চাইলেই বিনামূল্য ইন্টারনেট হতে শিখতে পারেন সেটার জন্য নাতো গুরু আর নাতো টাকা খরচ করতে হবে(অবশ্য ইন্টারনেট বিলটুকু পকেটে থাকা অবশ্য কর্তব্য)। আপনি চাইলে বাংলাদেশী বিভিন্ন টেক-ওয়েব,বিদেশী ফোরাম-ব্লগ আর উইকিপিডিয়া-উইকিহাউ এবং কোয়ারার মতোন শক্তিশালী স্কুলে বিনামূল্যেই ক্লাস করতে পারেন….প্রয়োজন শুধু শেখার মতোন ইচ্ছা,আগ্রহ-উৎসাহ,একনিষ্ঠা এবং ধৈর্য্য। সম্ভব হলে ইংলিশটা একটু একটু করে চর্চা করুন আর বিপদে ভাষাবিদ গুগল ট্রান্সলেটর তো আছেই।
প্রোগামিং-কোডিং-ওয়েব ডেভলপিং বিষয়ে বাজারে বহু বই পাবেন সেগুলি পড়ুন এবং চর্চা করুন।
ব্যক্তিগত অভিমত
আমরা সবাই লোকমুখে শুনে থাকি অমুক ব্যক্তির খালাতো শশুড়ের জ্যাঠাতো মামার ফুপাতো ভাই নাকি ইন্টারনেট হতে টাকা ইনকাম করে কোটিপতি হয়ে গিয়েছেন আদতে বিষয়টা হলো আলিফ লায়লার চিচিং ফাকের মতোই চিচিঙ্গা পাক,যেটা নেহায়েত বাচ্চা ভোলানো কাল্পনিক কল্পকথা মাত্র। আমাদের চোখের সামনে আমরা সফল মানুষ খুজে পাইনা তাই আজ আমি আমার নিজের কথা বলবো (এমন নয় যে আমি কোটিপতি আর নয়তো সফল মানুষ তবে চোখের সামনে সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি, বিচার বিবেচনা আপনার একান্তই ঐকান্তিক ব্যাপার)।
ইন্টারনেট হতে সত্যি সত্যিই টাকা ইনকাম করা যায় তবে সেটা রেফার কিংবা পিসিটি সাইট/এড দেখে নয়; নিজের সময়টাকে অহেতুক অন্যের উপার্জনের পন্থা হিসেবে চারআনা-আটআনা প্রাপ্তি নিশ্চয়ই সময়ের অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই না। ইন্টারনেট হতে ইনকাম করতে হলে সবার আগে আপনার পেটে শিক্ষা থাকতে হবে নয়তো আজীবন খালি পেটই হাহাকার করা ছাড়া ইন্টারনেটে কেউ আপনাকে দয়া করে ডেকে দুই মুঠো খাবার দিবে না,সুতরাং ইনকাম করতে চাইলে সবার আগে শিখুন। আপনি কোন বিষয়ে পারদর্শী কিংবা কোন বিষয়ে আগ্রহ আছে সেটা বিবেচনা করে ডিসিশন নিন যেমন আপনি গ্রাফিক্স শিখবেন নাকি ওয়েব ডেভলপার হবেন?
অনেক আগে আমি যখন একটি মাইক্রোজব প্লাটফর্মে ( নামটা বলছি না) কাজ করতাম তখন আমার প্রথম প্রজেক্ট বিড করে উইন হয়ে দেড় মাসের মতোন সময় লেগেছিলো তবে নিগোশিয়েশনের পর কাজটা আর কমপ্লিট করতে পারিনি (আজকাল অনেকেই হয়তো জানেই না যে আগে ইয়াহুতে ইমেইল চালাচালি করাও কতোটা মজার ছিলো;তখন রিকুয়েস্টে কাজের ওয়ার্ক অর্ডার আলাদা করে ইমেইলে জানিয়ে দিতেন।একজন ফ্রিল্যান্সার আর পাবলিশের মাঝে তখন সম্পর্কটা বেশ কৌতূহলী এবং শ্রদ্ধার ছিলো যেটা এখন শুধুই ফর্মালিটি)।এরপর ছোট ছোট কয়েকটি কনটেন্ট রাইটিং আর ট্রান্সেলেশনের কাজ করে প্রথম টাকার মুখ দেখি আইমিন ডলার ইনকাম করি( তখন অবশ্য শহুরে মফস্বলে আলাদা আলাদা মানি এক্সচেঞ্জার অফিস থাকতো)। এরপর আস্তে আস্তে ওয়েব ডেভলপিং এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি; আদতে স্মৃতিচারণের সেই অবসরটুকুইই আর পাওয়া হয়নি।
আমার ব্যক্তিগত কিছু পরামর্শ:
(১) আউটসোর্সিং করতে হলে সবার আগে আপনাকে শিখতে হবে তাই শেখার মতোন ধৈর্য্য থাকতে হবে। মনে রাখবেন আপনি যতো দ্রুত শিখতে পারবেন ততো দ্রুত ইনকাম করতে পারবেন।
(২) ফ্রিল্যান্সিং এর ক্ষেত্রে আপনার যোগ্যতা,রেপুটেশন,দক্ষতা এবং বিহ্যাভিয়োর’ই আসল কথা সুতরাং নিজেকে স্ট্যান্ডার্ড করে গড়ে তুলুন।
(৩) ফ্রিল্যান্সিং জগতে যারা নিউবাই তাদের জন্য পরামর্শ [ বিড করে উইন না হতে পারলে ধৈর্য্য হারাবেন না, একটা প্রজেক্টে কাজ না পেলে মন খারাপ করে বসে না থেকে বাকি কাজগুলোর দিকে কনসানট্রেট করুন। বিড করার সময় এডভান্স এমাউন্টের বিষয়ে সচেতন থাকুন ;এটা যেন বাজেটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হয় যেমন ৫০০০ টাকার বাজেটে ৫০% এডভান্স মানে ২৫০০ টাকা স্বাভাবিক, কিন্তু ৮০% এডভান্স চাওয়া যেমন অপ্রীতিকর ৫% চাওয়া তেমনি বিব্রতকর হতে পারে। ক্লায়েন্টের সাথে কখনোই খারাপ আচরন করবেন না, তিনি হয়তো আপনাকে পাম্পিং করে একটু বেশী কাজ করিয়ে নিতে চাইবেন যেমন “ফুটারের ডিজাইনটা অন্যরকম হলে ভালো হইতো” এমন ক্ষেত্রে সম্মানের সাথে আপনার সময়ের মূল্যের কথাটা জানিয়ে দিন এবং বিষয়টা এড়িয়ে যান। এছাড়া ক্লায়েন্টের সাথে ভালো ব্যবহার আপনাকে শুধু বর্তমান প্রজেক্টে নয় বরং রেপুটেশন ও নির্ভরতারর বিবেচনায় ভবিষ্যতেও কাজ পাওয়ার অগ্রাধিকার তৈরী করবে। ক্লায়েন্ট কনভিন্স করতে অফার করার বিষয়টি একইসাথে যেমন আপ-টু-ডেট তেমনি সোস্যাল মার্কেটিং হিসেবেও খুবই ইফেক্টিভ বটে]।
(৪)ফ্রিল্যান্সিং অবশ্যই একটি মুক্ত কর্মক্ষেত্র তবে নিজের ইউনিটি এবং ফোকাস ঠিক রাখা উচিত নইলে বিক্ষিপ্ত মানসিকতা কখনোই চূড়ান্ত সফলতা এনে দিতে পারবে না।
(৫) ফ্রিল্যান্সিং করার পাশাপাশি নিজের একটি ইউনিক ওয়েবসাইট খুলুন, এটা আপনার ভার্চুয়াল এ্যাসেট হিসেবে কাজ করবে (অনেক ধনী মানুষ যেমন পুরান ঢাকাতে থেকেও গুলশানে একটা ফ্লাট কিনে রাখে, নিজের আভিজাতিক পরিচয় ফুটানোর জন্য ঠিক তেমনি আরকি)। এছাড়াও আপনার অবসর সময়ে আপনার ওয়েবসাইটে কিছুটা সময় দিলে এডসেন্স হতেও একটি ভালো এমাউন্ট আর্ন করতে পারবেন।
(৬) কখনোই হতাশ হবেন না; নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসে সামনে এগিয়ে যাবেন। পিছে লোকে কি বললো তাতে কর্ণপাত করবেন না।
ইন্টারনেটের সুবিশাল জগতে আমি ধূলিকনার চেয়েও নগণ্যতম তথাপি ভার্চুয়াল ভিখারীদের হতে সচেতন করতেই এজ এন এক্সামপল আমি নিজের কিছু বক্তব্য তুলে ধরেছি মাত্র; আমি কাউকে আউটসোর্সিং/ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক কোর্স করাই না আর কোর্স করতে উৎসাহিতও করবো না।
হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান নয়
অবশ্যই প্রতিটি আউটসোর্সিং/ফ্রিল্যান্সিং কোর্সের পিছে আসল উদ্দেশ্যই থাকে টাকা উপার্জন (বিষয়টা খারাপ নয় কেননা টাকার প্রয়োজন সবারই আছে আর প্রত্যেকেরই সময়ের মূল্য আছে) তবে টাকা দিয়ে শিক্ষা কেনার আগে সচেতন হউন এবং নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো করুন
(১) আপনি কি শিখছেন? আপনি যা শিখবেন তার মার্কেটপ্লেস কেমন?
(২) আপনি যা শিখবেন সেটা শিখতে কতোটা সময় লাগবে? সময় শেষে প্র্যাকটিস নামে আপনি উক্ত ট্রেনিং সেন্টারে ভূতের বেগার খাটছেন না তো?
(৩) আপনাকে শুধু কাজ শিখিয়ে দিলে চলবে না বরং ইনকাম করার পরিপূর্ণ গাইডলাইন পাচ্ছেন তো?
(৪) কোর্সের শুরুতে আপনার সাথে তারা মন ভোলানো কথা বলবে তাই সেই সময়েই আপনি তাদের সাথে চুক্তি করুন “ইনকাম শুরু করা পর্যন্ত তাদের গাইডলাইন চান অর্থাৎ ইনকাম করা পর্যন্ত তারা যেন দায়বদ্ধ হয়। প্রয়োজনে টাকা দেবার আগে এমন চুক্তিপত্রে সিগনেচার করান। জানি এটা শুনতে অবাস্তব লাগছে কিন্তু সাইকোলজিক্যাল মোটিভেশনের অসহায়ত্বে এটাই একমাত্র মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে। তাদের প্রতিটি কথার পিছে থাকে নিদারুণ চাতুরতা তাই প্রয়োজনে অভদ্রের মতোন রাফ রাফ প্রশ্ন করতে দ্বিধা করবেন না।
শেষকথা
সবিশেষ আমি আউটসোর্সিং কোর্স করানো সবাইকে খারাপ বলছি না তবে নিজের সচেতনতা থাকলে নিশ্চয়ই ঐরকম ফ্রড ভার্চুয়াল ভিক্ষুকদের থেকে দূরে থাকবেন। আউটসোর্সিং মানে টাকা ইনকাম করা ; বাপের কষ্টের ইনকামের টাকা কোর্স-কোচিং এ দিয়ে আসার নাম আর যাই হউক স্বার্থক আউটসোর্সিং নয়।
সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, শুভকামনা রইলো।